সুরমা টিভি ২৪ নিউজ ডেস্ক:
খুলনার উপকূলীয় অঞ্চল গুলোতে সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিনের সমস্যা। যুগের পর যুগ ধরে এ সমস্যা অব্যাহত থাকলেও টেকসই কোনো সমাধান এখনো আসেনি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে নেয়া নানা উদ্যোগ ও প্রকল্প সত্ত্বেও সংকট নিরসনে কোনো দীর্ঘমেয়াদি সুফল মেলেনি। এ অবস্থার মধ্যে দিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস।পানির জন্য হাহাকার চারদিকে, যেখানে একটু সন্ধান মিলছে সেখানেই ছুটে যেতে হয় উপকূলবাসীর, তেমনি বদ্ধ এক জায়গাতে কোনো রকমে পানি সংগ্রহে এসেছেন এক গৃহবধূ।জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের তিন উপকূলীয় জেলায় লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়েই চলছে। সেই সঙ্গে সংকট বাড়ছে নিরাপদ পানির। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে উপকূলীয় এলাকার মানুষ নিরাপদ পানির জন্য করছেন হাহাকার। কিন্তু কোনো সমাধান মিলছে না। খুলনার দাকোপ উপজেলার বাজুয়া ইউনিয়নের চুনকুড়ি গ্রামে ২০১৯ সালে স্থাপিত সরকারি পানি শোধনাগার মাত্র এক বছরের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে। পরে বেসরকারি উদ্যোগে দুটি নতুন শোধনাগার স্থাপন করা হলেও সেগুলোর অবস্থাও একই। ওই এলাকার কৌশিক বৈরাগী বলেন, ‘গত পাঁচ বছরের মধ্যে এখানে তিনটি পিএএসএফ (পুকুরের পানি শোধনের প্রযুক্তি) বসানো হয়েছে। প্রথমটি এক বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। পরের দুটিও পরের এক বছরের মধ্যে কার্যকরিতা হারায়। আমরা চরম কষ্টে আছি। পানি সংগ্রহ করতে আমাদের অনেক দূরে যেতে হয়। শুধু এই প্রযুক্তি নয়, সরকারি-বেসরকারি এমন অন্তত ১০ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে গত ১০ বছরে উপকূলীয় এই এলাকায়। এর মধ্যে রিভার্স অসমোসিস, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্ট, পুকুর খনন প্রযুক্তি অন্যতম। কিন্তু কোনো প্রযুক্তি বা পদ্ধতিতে দীর্ঘমেয়াদী সুফল মেলেনি। দুর্ভোগ আর সংকট বাড়ছে তিন দশক ধরে পানি সংকট নিরসনে বিভিন্ন কাজ হলেও সুপেয় পানির সংকট বেড়েছে, শুধু সংকট বাড়েনি সংকটময় এলাকাও বেড়েছে। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরার অন্তত ৯ উপজেলার ৪৮টিরও বেশি ইউনিয়নের তিন লাখেরও বেশি পরিবার সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে কয়রা, পাইকগাছা আর দাকোপ উপজেলার বাসিন্দাদের মধ্যে সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে। নতুন করে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলারও কিছু কিছু এলাকায় খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পানি শোধনাগারগুলো টেকসই নয়, ফলে তারা বাধ্য হয়েই অনিরাপদ পানির উৎসের দিকে ঝুঁকছেন। পানখালি ইউনিয়নের জাবেরের খেয়া ঘাট এলাকায় ৩ কিলোমিটারের মধ্যে কোথাও সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই, ফলে নারীদের প্রতিদিন মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে পানি সংগ্রহ করতে হয়। কোথাও আবার সেই পানি না পেয়ে পুকুরের অনিরাপদ পানি সংগ্রহ করে পান করছেন, ব্যবহার করছেন দৈনন্দিন অন্যান্য কাজেও। ফলে পানি বাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।নলকূপ থেকে উঠেনা পানি, কোনো প্রকল্পই আসছে না কাজে। দাকোপ উপজেলার আকলিমা বেগম বলেন, ‘আমি এই এলাকায় বউ হয়ে এসেছি প্রায় ৩০ বছর। ৩০ বছর ধরেই আমি এখানে পানির সমস্যা দেখছি। বৃষ্টির সময় পুকুরের পানি ফিটকিরি দিয়ে শোধন করে পান করি, তাও খুব একটা ভালো হয় না। টিউবওয়েলে লবণ পানি ওঠে তা খাওয়া যায় না। ফলে তিন মাইল হেঁটে এক জায়গা থেকে পানি আনতে হয়, অথবা বেসরকারি সংস্থা থেকে পানি কিনে খেতে হয়। আমাদের তো পানি কিনে খাওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা নেই। যখন পানি আনতে দূরে যেতে না পারি বাধ্য হয়ে পুকুরের পানি পান করি ফলে ডায়রিয়া,পায়খানা লেগেই থাকে পরিবারে।একই উপজেলার আরেক বাসিন্দা বিলকিস আক্তার বলেন, যেখানেই ভালো পানির খোঁজ পাই, সেখানেই কলস নিয়ে দৌড় দেই। বছরের পর এই সমস্যা আমাদের। ষাট বছর বয়সী আব্দুল জলিল মোড়ল বলেন,এখন এই বয়সে আর পারি না, ঘরের মেয়েরা পানি আনতে যায়। ত্রিশ বছর ধরে শুনে আসছি, ট্যাংকি দেবে, কল দেবে। কল দেয়ও কিন্তু লবণ পানি ওঠে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে যে ট্যাংকি দেয়, তাতে পুরো গ্রামে একজনও পায় না। আমাদের চলবে কি করে? স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ব্যর্ উপকূলীয় এলাকার মানুষেরা পানির জন্য বার বার ধর্না দেন স্থানীয় জনপ্রতিনিদের কাছে।দাকোপের পানখালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাব্বির আহমেদ বলেন, সব লোক পানির জন্য আমার কাছে নালিশ করে, পানির ট্যাংক চায়। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে চাহিদার তুলনায় এসব প্রকল্পের সুফলভোগী খুবই সামান্য। আমাদের ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টি ইউনিয়নেই পানির সংকট চরমে। আমরা আসলে স্থানীয়দের কাছে আমাদের সীমাবদ্ধতার কথা জানাই। সরকারি দফতরে আবেদন দিলে তারা জানায়, বাজেটের অপ্রতুলতা রয়েছে। দাকোপ এখন পানি নিয়ে চরম মানবিক সংকটে রয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর জানিয়েছে, গত পাঁচ বছরে তিন উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় পানি সংকট নিরসনে ৬২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আটটি সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে অন্তত ১০ ধরনের প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৬-২০টি বেসরকারি সংস্থা আরও ৫০টির বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তবে এসব প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয়নি। সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জামানুর রহমান বলেন, আমরা কাজ করছি না এটা ভুল। আমরা কাজ করছি, সরকার বাজেট বাড়াচ্ছে। কিন্তু টেকসই হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সুফলভোগী পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণে কিছু গাফিলাতি আছে, আছে দক্ষতার অভাবও। মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের প্রশিক্ষিত করার পাশাপাশি সুফলভোগীদেরও আরও দক্ষ হতে হবে। তাহলে প্রকল্পগুলো আরও ভালো চলবে। তবে এটাই সমাধান নয় বলেও মনে করেন তিনি। বলেন,পানির সংকট নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করছি, কিভাবে আরও ভালো করা যায় এসব চেষ্টা করছি। তবে আমি মনে করি পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। গবেষকদের সুপারিশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপকূলীয় অঞ্চলের সুপেয় পানির সমস্যা শুধু একটি নির্দিষ্ট এলাকার সংকট নয়, এটি একটি জাতীয় সমস্যা। এটি সমাধানে টেকসই প্রকল্প গ্রহণ, পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং গবেষণা ভিত্তিক পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে, দিন যত যাবে, সংকট ততই বাড়বে। পানি বিশেষজ্ঞ ও ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ইনভারেমেন্টাল রিসার্স বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন,ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এ জন্য পানি নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের অদূর ভবিষ্যতের কথা এখনই চিন্তা করতে হবে। কেননা প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও দৃশ্যমান হচ্ছে। রাষ্ট্রের নীতি অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিক পানির অধিকার পাবে। রাষ্ট্র তাকে এটি দিতে বাধ্য। যে প্রকল্পগুলো তুলনামুলক ভালো ফল দেয়, সেই প্রকল্পগুলো আরও কিভাবে কাজ করে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে, গবেষণা করতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ আর পুকুর খননে জোড় দিতে হবে। এসব নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।