বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে নানা কর্মকাণ্ড। যে-সব দেশে নারীরা শিক্ষিত, সে সব দেশের নারীরা অনেকটাই স্বাবলম্বী। কোনো কোনো দেশে নারীরা এখনো অন্দরমহল বন্দী, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। আবার পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে নারীর অবস্থান ভিন্ন। দেশভেদে নারীর সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য খোলা চোখেই দৃশ্যমান।
প্রশ্ন হলে- নারী শিক্ষায় একটি দেশ এগিয়ে গেলেই কী নারীর ক্ষমতায়ন ঘটে? আবার শিক্ষা ব্যতীত নারীর ক্ষমতায়নের কোনো পথ আছে কি? দুটোর উত্তরই না-বাচক। প্রথমত- নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে নারীশিক্ষার বিকল্প নেই। এমন কোন সংক্ষিপ্ত পথ নেই, যে পথে শিক্ষা ব্যতীত নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ রয়েছে। তাই নারীশিক্ষার বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, তাহলে কি পুরুষ শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই বা গুরুত্ব নেই? আছে, অবশ্যই আছে। সেজন্যই সামগ্রিকভাবে শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে।
কিন্তু দেশে দেশে পুরুষ শাসিত সমাজে নারীকে পেছনে ফেলে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। নারীকে বিবেচনা করা হয়েছে সন্তান উৎপাদন যন্ত্র আর ভোগ্যপণ্য হিসেবে। এ মানসিকতার কারণেই নারীকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়। একই কারণে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে থাকা সমাজেও নারীকে পেছনে ফেলে রাখার চেষ্টা করা হয়।
এ বিষয়ে কবি নজরুলের কথা স্মর্তব্য- ..
.” যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠেছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারই রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!,…
নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে পিছিয়ে ঠেলার পেছনে পুঁজিবাদের শ্রম শোষণের কৌশল লুকিয়ে রয়েছে। পুঁজিপতিরা সুকৌশলে এ কাজটি করে থাকে। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এ কাজ সম্পাদন করে বলে প্রত্যক্ষভাবে দৃষ্টিগোচর হয় না। এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো শ্রম শোষণ। তারই বহি:প্রকাশ ঘটেছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ই মার্চ ।
সেদিন মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন।
সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয়, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগলো। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে।
১৯৮৫ সালে ৮ মার্চকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ১৯৯১ সালে এই দিবসটি পালন করা হয়। তাছাড়া প্রতিবছর জাতিসংঘ থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ঘোষণা করা হয়।
আমাদের দেশেও শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর একজন নারীর তুলনায় অনগ্রসর একজন নারীর দৈনিক মজুরিতে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। তাই সমাজতান্ত্রিক দর্শন মনে করে নারী মুক্তি বা নারীর ক্ষমতায়নের সমাধানের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন। রাষ্ট্র যদি শোষণযন্ত্র হয়, সে ক্ষেত্রে শুধু নারীরাই নয়, আপামর জনগণকেও পিছিয়ে রাখা হবে। তার অর্থ এ নয় যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত নারী মুক্তির প্রশ্নে নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকতে হবে। বরং নারীদের সংগঠিত করতে হবে অধিকার আদায়ে। এ সংগঠিত করার চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে হবে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা। তাহলেই সার্থক হবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের।
নারী তুমি সাহসী হও, এগিয়ে চলো।
জয়ী হোক নিপীড়িত মানুষের, সমাজ প্রগতির জন্য নারী সমাজের।
লেখক:সাংবাদিক